চমক হাসান
বুয়েটের সব ব্যাচের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এক জোট হয়ে আন্দোলন করছে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে। এই দাবিতে তারা কতখানি একাত্মতা বোঝা যায় একটা ছোট্ট ঘটনা থেকে।
৩০ মার্চ ২০২৪ ছিল ’২২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের (২০২২ সালে যারা এইচএসসি পাস করে বুয়েটে ভর্তি হয়েছে) বুয়েট জীবনের প্রথম টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা, যেটা একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই পরীক্ষায় প্রায় ১৩০০ শিক্ষার্থীর কেউ অংশ নেয়নি। একজনও না। পরেরদিন ’২০ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ১২১৫ জনের ভেতরে অংশ নিয়েছে মাত্র ২ জন। ১২১৩ জন বিরত থেকেছে পরীক্ষা দেওয়া থেকে।
‘বুয়েটে আড়িপেতে শোনা’ নামে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটা সক্রিয় ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম আছে। সেইখানে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন আছে কিনা তা নিয়ে একটা ‘পোল’ বা ভোটাভুটির আয়োজন করা হয় ৩১ মার্চ ২০২৪। ৪০৫৯ জন তাতে অংশ নিয়েছে। তার ভেতরে মাত্র ১৭ জন মনে করে রাজনীতির দরকার আছে। বাকি ৪০৪২ জন মনে করে এর কোনো প্রয়োজন নেই।
উল্লেখ্য যে, এই গ্রুপের সদস্য হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো জামায়াত বা ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা যাবে না। এই ভোটাভুটির ফল যে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থেকে এসেছে এমনটা বলারও অবকাশ নেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রাক্তন এবং বর্তমান শিক্ষার্থীদের শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশি অংশ মনে করে ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই।
এমন কেন হলো? রাজনীতি তো মানুষের অধিকার। রাজনীতি মানুষকে কণ্ঠ দেয় তার মতামত তুলে ধরার, শক্তি দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে রুখে দাঁড়াবার। তাহলে এমন জরুরি একটা অধিকার কেন স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দিতে চায় বুয়েটের সিংহভাগ শিক্ষার্থী? মানুষ অধিকার বিসর্জন দিতে চায় তখনই, যখন সেই অধিকার আদতে অভিশাপ হয়ে আসে। বুয়েটে হয়েছেও তাই।
স্বাধীনতা পরবর্তী বুয়েটের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, ছাত্ররাজনীতির সুফল এখানে কখনো মেলেনি। কিন্তু দুষ্কর্মের প্রমাণ অনেক। ৮ জুন ২০০২ টেন্ডার নিয়ে ছাত্রদলের দুই পক্ষের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সাবেকুন নাহার সনি। ২ জুলাই ২০১৩ হেফাজত সমর্থক বুয়েট ছাত্রের চাপাতির আঘাতে আহত হয়ে ছাত্রলীগ কর্মী আরিফ রায়হান দীপ নিহত হয়। ৭ অক্টোবর ২০১৯ আবরার ফাহাদকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের কর্মীরা।
আবরারের মৃত্যুর ঘটনার প্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে এর আগের নির্যাতনের খবরগুলোও। শিক্ষার্থীদের কী জঘন্যভাবে র্যাগ দেওয়া হতো, মিছিলে না গেলে কীভাবে নির্যাতন করা হতো, শুধুমাত্র বড়ভাইদের সালাম না দেওয়ার কারণে কী করে স্ট্যাম্পের আঘাতে পা ভেঙে দেওয়া হতো—এমন অনেক ঘটনা সামনে আসে।
বিশেষ করে আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাসগুলো ছিল নরকের মতো। ভয়ংকর সময়ের মাঝে পাড় হয়েছে সেই সময়ের শিক্ষার্থীরা। নিষ্ঠুর মৃত্যু যেন ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আবরার নিহত হয়েছে, সেই জায়গায় অন্য কেউ হতে পারতো। এই ঘটনার পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা এক হয়ে আন্দোলন করলে প্রশাসন বুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। এর ফলাফল কী হলো? আবরার পরবর্তী সময়ে যারা বুয়েটে ছিল, তাদের সাথে কথা বললেই এর উত্তর পাওয়া যায়, রাজনীতিবিহীন এই সময়টা ছিল খুবই শান্তিপূর্ণ। অপমান বা অত্যাচারের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতে হয়নি কাউকে।
এমন এক পরিস্থিতিতে যদি আবার ছাত্ররাজনীতির প্রবেশের পথ খুলে দেওয়া হয়, সাধারণ শিক্ষার্থীরা তা মেনে নিতে চাইবে কেন? সুস্থ মস্তিষ্কের কোন মানুষটি চাইবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছেড়ে নরকে ফিরে যেতে? আরেকটা সনি, দীপ বা আবরার হতে চায় না কেউই। ফলে তাদের এই চাওয়াকে অত্যন্ত যৌক্তিক বলেই মনে হয়।
ছাত্ররাজনীতি না থাকলে কী কী হতে পারে, তা নিয়েও ভাবা যেতে পারে। কেউ কেউ বলেছেন, দক্ষ নেতৃত্বের বিকাশ হবে না। সেই যুক্তি খণ্ডানো সহজ। বুয়েটে যেকোনো গণআন্দোলনে নেতৃত্বে থাকে সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। যেমন এবারে আছে ১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। প্রত্যেক ব্যাচ প্রতি বছর এন্ট্রান্স ডে, লেভেল কমপ্লিশন, র্যাগ ডে—এমন সব অনুষ্ঠান আয়োজন করে। প্রতিটা ডিপার্টমেন্টে নিজস্ব ‘ডে’ অনুষ্ঠান হয়, সেইখানেও সেই বিভাগের শিক্ষার্থীরা আয়োজক হিসেবে থাকে।
এছাড়া বিতর্ক ক্লাব, সাংস্কৃতিক সংগঠন মূর্ছনা, বিজ্ঞান ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি—এমন ৩১টি ক্লাব আছে, যেগুলো নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বছরজুড়ে। প্রত্যেক জায়গায় নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ থাকে। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ দিবসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। রাজনৈতিক প্রভাবের প্রয়োজন কিন্তু হয় না এর জন্য।
ছাত্রলীগের কর্মীরা বলছেন যে, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সময় ছাত্রলীগের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও ছাত্রদল বা ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের কার্যক্রম গোপনে চালিয়ে গেছে। ছাত্রদল তাদের কমিটি ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে আবরার হত্যা পরবর্তী সময়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিল একজন বুয়েট শিক্ষার্থী। তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইসলামী ছাত্রশিবিরকে প্রতিহত করেনি। এই বক্তব্যগুলোর পুরোপুরি অযৌক্তিক নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই জায়গায় আরেকটু শক্ত হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তারা কেন একে গুরুত্ব দেয়নি তা বোঝাও কঠিন নয়।
দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের মতোই ক্ষমতাসীন দলের বাইরের ছাত্রসংগঠনগুলোর আদতে কোনো ক্ষমতা নেই। ছাত্রদল বা ইসলামী ছাত্রশিবির কেউই প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম করার সাহস দেখায় না। আর ছাত্রদলের কমিটির সবাই ছিল প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তারপরও অন্য দলগুলোর গোপন কার্যক্রম রুখে দেওয়ার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই আরও সতর্ক হতে বলা যেতে পারে।
প্রশাসনের সরাসরি সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের হলগুলোয় মনিটরিং সেল বানিয়ে তা লক্ষ্য রাখা যেতে পারে। কিন্তু এর জন্য ছাত্রলীগকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনার দরকার নেই। কাউকে শাসন করার কোনো বৈধতা ছাত্রলীগের নেই।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের অরাজনৈতিক ক্যাম্পাসের দাবি থেকে সরে যায়নি কিন্তু সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট বুয়েটের ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিজ্ঞপ্তিকে স্থগিত করেছেন। ফলে রাজনীতি পুনঃপ্রবেশের পথও সুগম হয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ মহা-উৎসাহে চার দফা কর্মসূচি নিয়ে বুয়েটে আবার রাজনীতি শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। এই অবস্থায় আইনগতভাবে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে ভাবছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
এই অবস্থায় আমি মনে করি, শিক্ষার্থীরা যে ঐক্য দেখিয়েছে, তা ধরে রাখা জরুরি। যদি তারা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে, তাহলে তাদের যে মূল লক্ষ্য—সেই শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা এখনো সম্ভব। নিজ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ভেতরে ঐক্য রাখতেই হবে। একাধিক ব্যাচ একসাথে হলে সিনিয়র ব্যাচের নেতৃত্বে ভরসা রাখতে হবে। সবাই এক থাকলে গুটিকতক রাজনৈতিক ব্যক্তি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারবে না কিছুতেই।
বুয়েটের প্রশাসন এবং শিক্ষকদের ভূমিকাও এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি যখন দ্রুত খারাপ হয় শিক্ষকেরা তখন রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেন। এটা ঠিক না। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটিতে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ কার্যকর হলেও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু চালু রাখা হয়েছিল আইয়ুব খানের ’৬১ এর অধ্যাদেশ। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হস্তক্ষেপে এটা ঘটেছিল। তিনি চেয়েছিলেন অন্তত এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। তার দূরদৃষ্টি এখনো প্রাসঙ্গিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল-চিন্তায় শিক্ষক-প্রশাসনের রাজনীতির প্রভাবমুক্ত থাকা খুব জরুরি।
শিক্ষকেরা যদি পক্ষপাতহীন থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে রাখতে পারেন আর শিক্ষার্থীরা যদি ঐক্য এবং সাহসিকতা ধরে রাখতে পারে, তাহলে ছাত্ররাজনীতি থাকুক বা না থাকুক, তারা স্বাভাবিকভাবে ছাত্রজীবন পার করতে পারবে। প্রশ্ন যেখানে অস্তিত্বের, ভয়কে সেইখানে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।
ছাত্ররাজনীতির অন্ধকার ছায়া থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত হোক। আর কোনো শিক্ষার্থীকে র্যাগিং, অত্যাচার, দমন-নিপীড়নের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ক্যাম্পাস জীবন কাটাতে না হোক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে এইটাই আমার চাওয়া।
চমক হাসান ।। গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকৌশলী; প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বুয়েট