ঢাকা শনিবার, জানুয়ারী ১৮, ২০২৫

Popular bangla online news portal

Janata Bank
Rupalibank

জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততার প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলের নারীরা


নিউজ ডেস্ক
৫:১৪ - শনিবার, ডিসেম্বর ২, ২০২৩
জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততার প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলের নারীরা


ইমরান হোসেন ঃঃ জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান পৃথিবীর একটি অন্যতম উদ্বেগের বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতিবছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল অনেক বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন উপকূল অঞ্চলের অন্যতম একটি প্রান্তিক এলাকা। এই ইউনিয়নের চারপাশে নদী প্রবাহিত হওয়ায় এটি একটি দ্বীপের মতোই। প্রায় ৪০ হাজার জনসংখ্যার ইউনিয়নে রাস্তাঘাটের চরম বেহাল দশা এবং ন্যূনতম সুযোগ সুবিধার অপ্রাপ্তিতে নারীরা সবসময় ভালনারেবল অবস্থানে থাকছেন। চারপাশে নদী এবং ইউনিয়নের অভ্যন্তরে মাছের ঘেরের কারণে এখানে লবণাক্ততার প্রভাব অতিমাত্রায়। টিউবয়েলের পানি এখানে খাবার অযোগ্য। লবণাক্ততার কারণে নারীদের জীবন রীতিমতো দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।

এখানে অধিকাংশ পরিবার সুন্দরবনের এবং নদীতে জাল ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের স্বামীরা সুন্দরবনে যাবার আগে ইউনিয়নের একমাত্র বাজার থেকে কয়েকদিনের বাজার করে দিয়ে যায়। বাজারটি অনেক দূরে অবস্থিত ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র শেষ হয়ে গেলেও নারীরা সেটির ব্যবস্থা করতে পারেন না। গৃহবধূ রিমা আক্তার (২৪) জানান লোনা পানি দীর্ঘদিন ব্যবহার করার কারণে তারা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা এবং রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মেনসষ্ট্রুয়েশনের সময় জীবাণুযুক্ত লোনা পানির ব্যবহার তাদের চুলকানি সহ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। এজন্য মেনসষ্ট্রুয়েশনের  বন্ধ রাখতে তারা বাধ্য হয়ে পিল খাচ্ছেন।

বর্ষার পানি টাংকিতে জমা করে সারা বছর খেতে হয় তাদের। তবে খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষের এই সক্ষমতা আছে। টাংকি যাদের নাই তারা নদীর ওপার থেকে তথা মুন্সিগঞ্জ থেকে সিরিয়াল দিয়ে ড্রামে করে পানি নিয়ে আসে। যাদের এই সুবিধা নেই তারা পুকুরের পানি খায়।

তবে পুকুরের সংখ্যা কম থাকায় অনেকেই এই পুকুর খুঁজতে মাইল /আধা মাইল পথ হাঁটতে হয়।

এই পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। পানির দায়িত্বটা পুরোটাই পরিবারের মহিলা সদস্যের ওপরে বর্তায়। পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ উভয়েই নারীর দায়িত্ব থাকে।

এই পানির গুনমান অত্যন্ত খারাপ। পানির পর্যাপ্ততার অভাব এবং লবণাক্ততার প্রভাবে দাঁদ, পাঁচড়া, চুলকানি সহ বিভিন্ন রোগ তাদের সারা বছর থাকে।

লবণাক্ততার প্রভাবে তাদের হাঁস মুরগি মরে যায়। লবণ পানি খেয়ে পেট ফুলে ছাগল মারা যায়। তাদের শাকসবজি মারা যায়। বছরে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বর্ষার সময় তারা শাকসবজি লাগাতে পারে বাকি সময় সবুজের কোন অস্তিত্ব নেই। স্থানীয় কোন পশুর ডাক্তার নেই। শ্যামনগর সদরের ছাড়া ডাক্তারের কোন দেখা পাওয়া যায় না।

শাকসবজি খেতে না পারার কারণে এবং পুষ্টিকর খাবারের অভাবে তাদের শরীরে দুর্বলতা, হৃদপিন্ডের কাপনী, রক্তশূন্যতা, কাজ করতে গেলে দম লেগে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। টাটকা শাকসবজির অভাবে তারা দূরের বাজার থেকে কিনে আনা শুকনো শাকসবজি খেতে হয়। গর্ভবতী নারীদের জন্য এই পুষ্টির অভাব অতিমাত্রায় সেখানে।

মাসিকের সময় তারা যে কাপড় ব্যবহার করে সেটি ঠিকমতো ধোয়ার জন্য পানির পর্যাপ্ততা নেই। খাবার পানির যেখানে সংকট সেখানে ব্যবহার্য পোষাকাঁদি পরিষ্কার করা খুবই কঠিন। ঠিকমতো ব্যবহারের কাপড় না ধোয়ার ফলে জীবানু ছড়ায় ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় যেমন অনেক সময় সাদা স্রাব হয় যেহেতু সারতে চায় না। প্রতিটি মহিলা পুকুরের লোনা পানিতে টিউবয়েলের লোনা পানিতে গোসল করে।

স্থানীয় সমাজকর্মী নুরুন্নাহার বেগম (২২) জানান,লোনাপানির প্রভাবে পুষ্টির অভাবে অনেকের বাচ্চা রোগা পাতলা এবং ঠিকমতো ওজনের অভাবে জন্ম নিচ্ছে। লবন পানির কারণে ঠিকমতো গোসল করতে পারে না মা। শিশুদের সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। লোনা পানি গর্ভবতী মায়েরা বেশি একটা খেতে পারে না পারে তাদের বাচ্চাদের জন্য দুধের ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয়। লবণ পানিতে ভাত রান্না করলে খাবারের অরুচি দেখা দেয়। লোনা পানিতে গোসল খাওয়া-দাওয়া এবং সবকিছু দৈনন্দিন কাজকর্ম করার কারণে মানসিকভাবে বিষন্নতা আফসোস এবং মনো কষ্টে ভোগেন তারা।লোনাপানির কারণে জরায়ূতে ইনফেকশন হয় ফলে এটা বন্ধ করতে বড়ি ও ইনজেকশন নিতে হয় তাদের। এসব কারণে তারা ঝুঁকির কাজ করার বদলে সাধারণ কাজ করতে হয়। মাটির ঝুঁড়ি কাঁধূ তুলতে পারেন না। জরায়ু ইনফেকশনের কারণে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে নিয়মিত ঝগড়া হয়। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ের জন্য স্ত্রীকে চাপ প্রয়োগ করে ‌‌। তাছাড়া পানির জন্য রান্নার স্বাদ ঠিকমতো না হলে স্বামীদের হাতেও অত্যাচারিত হতে হয় তাদের। পানি আনার জন্য স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয় ‌‌।

ইউনিয়নে কোন জরুরী মেডিকেল ইউনিট নাই, ডাক্তার নাই, কমিউনিটি ক্লিনিক আছে সেটাও অনেক দূরে, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং যানবাহন এতটাই খারাপ যে বর্ষার সময় সেখানে যাওয়া অসম্ভব। যে কোন অসুস্থতার জন্য এই শ্যামনগর যেতে যেতে হয। শ্যামনগর অনেক দূরে ও নদী পারাপার হতে হয় এবং জরুরী পরিস্থিতির সময় মা এবং শিশুর প্রবল মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে।চারিদিকে লবন পানি কারণে যেখানের পুকুরে একটু ভালো পানি সেখানে অনেকের প্রতিযোগিতা করে পানি আনতে হয় এবং মাঝেমধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগে যায়। ঘাবড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জি এম মাসুদুল আলম বলেন, লবণাক্ততার কারণে তার ইউনিয়নে নারীর অত্যন্ত কষ্টে আছেন। সুপেও পানির অভাব অন্যতম বড় সমস্যা। তিনি জানান ইউনিয়নে কোন এনজিও অথবা সরকারি উদ্যোগে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা করা আশু জরুরী। যাতায়াত ব্যবস্থার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলা,আমফান,ইয়াসে ইউনিয়নের রাস্তাঘাটের চরম ক্ষতিসাধন হয়েছে। তবে তারা চেষ্টা করছেন এই সমস্যার সমাধানের।

স্থানীয় মানুষজনের ভাষ্যমতে,সমাধান হিসেবে তারা চারপাশের লবণাক্ত পানির মৎস্যঘের বন্ধ হওয়ার কথা এবং ধানের সুপারিশ করেছেন। সবার জন্য একটি করে পানি জমা রাখার টাংকি এবং একটি সরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের প্রয়োজন উল্লেখ করেছেন।