দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে ও স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এজন্য গ্রহণ করা হচ্ছে বড় বড় সব মেগা প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়নে আস্থার সাথে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে কোন কোন প্রতিষ্ঠানের অতীত যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি রয়েছে দুর্নীতির ইতিহাস।
এক্ষত্রে, উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ডিজিটাল সংযোগ বৃদ্ধিতে টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর আধুনিকীকরণ (এমওটিএন) প্রকল্পের কথা। এ প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) নেটওয়ার্কের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শুরুতেই ধাক্কা খায় এ প্রকল্প। অভিযোগ ওঠে নিয়ম ভঙ্গ করে কোনো বিশেষ চীনা প্রতিষ্ঠানকে এ প্রকল্পের কাজ দেয়া হয়েছে। নানা মহল থেকে অভিযোগ করা হয় কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট চীনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন কারসাজি ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে, যদিও বিশেষ ওই প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাবিত বিডিং মূল্য বেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অনুযায়ী, সরাসরি ক্রয়পদ্ধতির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভার অনুমোদন বাধ্যতামূলক। কিন্তু মন্ত্রিসভার অনুমোদন নেয়ার আগেই বিটিসিএল ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চীনের জেডটিই হোল্ডিং কো. লিমিটেড ও জেডটিই করপোরেশনকে মনোনীত করে এবং ২৩১ মার্কিন ডলারে এ প্রকল্প চূড়ান্ত করে, যা স্পষ্টভাবেই আইনের লঙ্ঘন।
এজন্য বিটিসিএল ও জেডটিই উভয়ের বিরুদ্ধেই অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আর চীনের নির্দিষ্ট এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে মেগা প্রকল্প হাতিয়ে নিতে অসদুপায় অবলম্বনের পূর্ব ইতিহাসও রয়েছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ১০৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার বিটিসিএল’র অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। এখন পর্যন্ত, দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করতে পারেনি বিটিসিএল। কিন্তু এরই মধ্যে, এ নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ ইন্টারনেট গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। অভিযোগ করা হয়েছে কোনো পরামর্শক নিয়োগ না দিয়ে পক্ষপাতিত্ব করে একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার পাঁয়তারা চলছে।
জেডটিই’র বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়! অন্যান্য দেশেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সহ অন্তত ১৮টি দেশে জেডটিই’র বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করার জন্য জেডটিই-কে ২০১৭ সালে তিন বছর মেয়াদে শাস্তি পেতে হয়। এছাড়াও, ফিলিপিন ন্যাশনাল ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক কন্ট্রোভার্সি, যা এনবিএন-জেডটিই চুক্তিতে দুর্নীতি কেলেঙ্কারি নামেও পরিচিত এর খবর প্রকাশিত হয়।
এমনকি বাংলাদেশ অনিয়মের কারণে সংবাদ শিরোনামে স্থান করে নেয় জেডটিই। ২০২০ সালে জেডটিই করপোরেশনের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ আনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতিষ্ঠানটির সাথে কাজ করা ৫টি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানকে অবিলম্বে চুক্তি বাতিল ও তদন্তে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেয় এনবিআরের ইনভেস্টিগেশন সেন্টার (সিআইসি)।
এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে এমন একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেশের মেগা প্রকল্পের কাজ দেয়া যেকোন সুবিবেচকের মনেই প্রশ্নের উদ্রেক ঘটাবে। আর এটা করা হলে শুধুমাত্র জনগণের অর্থেরই অপচয় ঘটবে এবং জনগণের স্বার্থে মহৎ উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা সরকারের উদ্যোগই কলঙ্কিত হবে। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতে সরকার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোকে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার আগে তাদের অতীতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেয়া দরকার এবং এমন প্রতিষ্ঠানের সাথেই কাজ করা উচিত যাদের কাজে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা রয়েছে।