আছিয়া খাতুন গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় একটা গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি করে। তার স্বামী আমিরুল ইসলাম উত্তরার এক বাড়িতে ব্যক্তিগত গাড়ি চালায়। তাদের তিন বছরের সংসারে আছিয়া প্রথম মা হতে যাচ্ছে। সংসারের নতুন অতিথি আসার সংবাদে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খুব খুশি হলেও এর মধ্যে আছিয়া ভাবে স্বল্প আয়ে দুজনের সংসার চালাতেই কষ্ট হয়, এ সময় আমার বাড়তি খরচ! তাই ভাবে মাতৃত্বের এ সময় কতদিন চাকরিতে যেতে পারবে। যদিও তার গার্মেন্টস অনেক কর্মীবান্ধব। নারীকর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে তার গার্মেন্টস।
পরে কারখানা প্রশাসনকে মা হওয়ার বিষয়টি জানাতে গেলে তাকে একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, ছবি ও ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে কারখানায় আসার জন্য বলা হলো। পরদিন এসব নিয়ে সে অফিসে দেখা করলে একটা ফরম পূরণ করতে বলে তাকে কর্তৃপক্ষ। তাকে জানানো হয়, সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মা ভাতা হিসেবে স্বল্প আয়ের কর্মজীবী মায়েদের তিন বছর মেয়াদে মাসে আটশ টাকা করে প্রদান করে, যাতে করে এ টাকা দিয়ে গর্ভকালীন মায়েরা পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারে। এখন থেকে প্রতি তিন মাস পরপর তার মোবাইল ব্যাংকের হিসাবে এ টাকা জমা হবে। বেতনের সঙ্গে প্রতি মাসে কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মা ভাতা পাওয়ার এ সংবাদে মুহূর্তের মধ্যে আছিয়ার এতদিনের সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।
কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল কর্মসূচি মাজাতির সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রতি জাতীয় স্বীকৃতি। দুই লাখ পঁচাত্তর হাজার কর্মজীবী মায়ের জন্য এই সহায়তা দরিদ্র মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য, পুষ্টির উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার গৃহীত একটি অন্যতম সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম, যার মাধ্যমে গর্ভধারণকাল থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত ৮০০ টাকা করে নগদ অর্থ, আর্থসামাজিক ও সচেতনতামূলক সেবা প্রদান করা হয়। বাল্যবিয়ে ও যৌতুকের জন্য নির্যাতন রোধকল্পে শুধু ২০ বছরের অধিক বয়সী দরিদ্র কর্মজীবী গর্ভবতী এবং দুগ্ধদায়ী মায়েদের ক্ষেত্রে প্রথম বা দ্বিতীয় গর্ভধারণকালে এ ভাতা প্রদান করা হয়। পাইলট কর্মসূচি হিসেবে প্রথম পর্যায়ে কর্মসূচিটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও গাজীপুর এলাকায় অবস্থিত বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোসহ দেশের ৬৪ জেলা সদরের পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন ও সাভার উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ ছাড়া পল্লী অঞ্চলের দরিদ্র, গর্ভবতী মায়েদের অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য সরকার ‘দরিদ্র মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচি থেকে ৭ লাখ ৭০ হাজার মা গর্ভধারণকাল থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত ৮০০ টাকা করে নগদ অর্থসহ প্রশিক্ষণ সুবিধা পাচ্ছে। এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র মা ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাস, মাতৃদুগ্ধ পানের হার বৃদ্ধি, গর্ভাবস্থায় উন্নত পুষ্টি উপাদান গ্রহণ বৃদ্ধি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এ কার্যক্রমের আওতায় দরিদ্র গর্ভবতী নারীদের ভাতা প্রদানের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসংক্রান্ত এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। মায়ের গর্ভাবস্থা থেকে ৩ বছর পর্যন্ত মা ও শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে।
সরকার এই দুই কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ মা ও সন্তানদের পুষ্টি নিশ্চিত করে যাচ্ছে, যা আগামী প্রজন্মকে মেধাবী ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলবে। অর্থনীতির সব সূচকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শিশুদের জন্য বিনিয়োগ। শিশুদের ওপর বিনিয়োগ করলে তার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে দেশ ও সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন প্রত্যেক শিশুর অন্ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ ও তা নিশ্চিত করা। সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এ শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষার জন্য যেসব অভীষ্ট ও লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা অর্জনে কাজ চলমান রয়েছে। ২০৪১ সালে দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে এ পরিক্রমায় সরকার শিশুদের ওপর কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ করছে। এ লক্ষ্যে সরকারের পনেরোটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ আশি হাজার কোটি টাকার শিশুকেন্দ্রিক বাজেট বাস্তবায়ন করছে। এই শিশুকেন্দ্রিক বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার আগামী প্রজন্মকে মেধাবী ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলবে। জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ প্রণয়ন করে। কিন্তু এর ঠিক ১৫ বছর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ ও কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করেন।
বাংলাদেশে শিশু বলতে ২০১৩ সালের শিশু-আইনে ১৮ বছরের নিচের সব ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭-এ শিশু বলতে ১৮ বছরের নিচে যে কোনো ব্যক্তিকে শিশু বলা হয়েছে। ১৯৮৯ সালের জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদেও ১৮ বছর বয়সী সব মানুষকে শিশু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ শিশু। সে হিসেবে বাংলাদেশে শিশুর সংখ্যা মোট ছয় কোটি চল্লিশ লাখ। এই শিশুদের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন মৌলিক অধিকার। কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়াই কিছু মৌলিক মানবাধিকার প্রতিটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য জরুরি। এই অধিকারের সমষ্টিকে শিশু অধিকার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বপরিম-লে শিশুদের জন্য বিভিন্ন কনভেনশন, চুক্তি প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতিসংঘের আওতায় আন্তর্জাতিক শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) গঠন করা হয়েছে। আমাদের সংবিধান এবং বিভিন্ন আইনেও শিশুদের বিভিন্ন অধিকারের কথা বলা হয়েছে। শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য যারা রাষ্ট্র, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পরিবারসহ সব স্তরে শিশুবান্ধব সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব, যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুন্দরভাবে বিকশিত হতে পারে। শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তাদের জন্য কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিশুরা তাদের মর্যাদার বিষয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাদের যথাযথ মানসিক বিকাশের জন্য তাদের সঙ্গে সব সময় ভালো আচরণ করতে হবে এবং চারপাশের পরিবেশ নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শিশুদের জন্য সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। জাতির পিতার সেই অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস। মা ও শিশুমৃত্যু রোধসংক্রান্ত এমডিজির লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। ডে-কেয়ার সেন্টার, শিশু বিকাশকেন্দ্র, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র, প্রারম্ভিক মেধা বিকাশ, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের যথাযথ বিকাশের জন্য নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা গত দশ বছরে শিশুর উন্নয়ন ও সুরক্ষায় বিভিন্ন যুগান্তকারী আইন, নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এসবের মধ্যে জাতীয় শিশুনীতি ২০১১, শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের সমন্বিত নীতি-২০১৩, শিশু আইন ২০১৩, ডিএনএ আইন ২০১৪, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭, যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আইন-২০১৮ উল্লেখযোগ্য। বছরের প্রথম দিনেই দেশব্যাপী সব শিশুর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া এবং ঝরে পড়া রোধে বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল চালু করার যুগান্তকারী কার্যক্রমও বাস্তবায়িত হচ্ছে। শিশুদের যথাযথ বিকাশ ও দক্ষ ক্রিড়াবিদ হিসেবে গড়ে তুলতে ¯ু‹লগুলোতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, শিশুর পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, শিশু নির্যাতন এবং শিশু পাচার রোধসহ শিশুর সামগ্রিক উন্নয়নে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সফলতা অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাউথ সাউথ, পিস ট্রি, প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল উইমেন্স লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড, লাইফটাইম কন্ট্রিবিঊশন ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন। টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৯ সালে পেয়েছেন গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন বা ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার।
শিশুর জন্য যে নিরাপদ পরিবেশ প্রয়োজন, তা যে কোনো অবস্থায় আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধক্ষেত্র, শরণার্থী শিবির, উত্তাল সমুদ্র সব স্থানেই শিশুরা আজ চরম সংকটে। বিশ্বব্যাপী শিশুর প্রতি সহিংসতার পাশাপাশি এ বছর যোগ হয়েছে মহামারী পরিস্থিতি। কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে অসহায় ধনী-দরিদ্র, শিশু-বৃদ্ধ সবাই। এ কঠিন পরিস্থিতিতে শিশুদের প্রতি আমাদের বিশেষ যত্নবান হতে হবে। শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষায় সবাইকে সর্বোচ্চ সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। শিশুর জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা একান্ত প্রয়োজন। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের মাঝেই লুকিয়ে আছে আমাদের আগামীর পৃথিবী। কারণ শিশুরাই ওড়াবে আগামী দিনের ঘুড়ি। সুরক্ষিত রাখবে দেশের পতাকা। শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল সফল হবে আমাদের প্রতিদিনের কর্মকা-। এজন্য পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেককেই যার যার অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।
৫ অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিশুর সাথে শিশুর তরে, বিশ্ব গড়ি নতুন করে’ । ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠনসহ ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে আমাদের আজকের শিশুরাই। সুতরাং শিশুর পাশে থেকে তাদের জন্য নিরাপদ, সুরক্ষিত ও আনন্দময় বিশ্ব গড়ে তুলব আমরা- এ হোক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আমাদের অঙ্গীকার। লেখক : প্রাবন্ধিক