ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের আনন্দনগরের জন্য স্যুয়ারেজ ও অন্যান্য ময়লা পানি অপসারণে লাইন করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সংস্থাটি। লাইনটির মাধ্যমে আফতাবনগরের নতুন প্রকল্পের রাস্তা কেটে আফতাবনগর ও বনশ্রীর মাঝের খালে স্যুয়ারেজ, ডাস্ট ওয়াটার ফেলতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছে।
তবে এর বিরোধিতা করে অন্য কোনো উপায়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন আফতাবনগরের বাসিন্দারা। তারা বলছেন, কেউই চায় না আফতাবনগরের নতুন রাস্তা কেটে স্যুয়ারেজ লাইন হোক বা এই সংযোগ খালে স্যুয়ারেজের ও ডাস্ট ওয়াটারের লাইন আসুক।
ওই প্রস্তাবনার বিরোধিতা করে ইতোমধ্যে আফতাবনগরের পাশাপাশি পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ, ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড, জহুরুল সিটি সোসাইটি ইতোমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দিয়েছে। তারা ডিএনসিসির কাছে অনুরোধ জানিয়েছে যেন নতুন রাস্তা কেটে আফতাবনগর ও বনশ্রীর মাঝের খালে স্যুয়ারেজ, ডাস্ট ওয়াটার লাইন না করা হয়।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন গেল নভেম্বর মাস থেকে নতুন স্যুয়ারেজ, ডাস্ট ওয়াটার লাইন তৈরির কাজ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়ে সহযোগিতা চাইছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে আফতাবনগরের বাসিন্দারা নতুন রাস্তা না কাটার দাবি জানিয়ে বলেছেন, অন্য এলাকার জন্য স্যুয়ারেজ লাইন, ডাস্ট ওয়াটার লাইন করার জন্য তারা চান না তাদের এলাকার নতুন সুন্দর রাস্তার ক্ষতি হোক। পাশাপাশি আফতাবনগর-বনশ্রীর মাঝের খালে যেন কোনোভাবেই এ লাইন আসতে না পারে।
আফতাবনগর সি ব্লকের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, কিছু দিন ধরে এ বিষয়ে আমাদের এলাকায় বেশ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। আমরা কোনোভাবেই চাই না অন্য এলাকার জন্য স্যুয়ারেজ লাইন, ডাস্ট ওয়াটার লাইনের জন্য আমাদের নতুন রাস্তার কোনো ধরনের ক্ষতি হোক, খালের পরিবেশ নষ্ট হোক। আমরা পুরোপুরি এর বিরুদ্ধে। সিটি কর্পোরেশনকে বলব আমাদের ক্ষতি করে এমন লাইন আমরা হতে দেব না।
আফতাবনগরের আরেক স্থায়ী বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, একে তো নতুন রাস্তা নষ্ট করতে আমরা চাই না। এ ছাড়া পরিবেশের ক্ষতি করে খালে এমন লাইন আমরা হতে দেব না। এটা সবাই জানে ওই সড়কের নিচ দিয়ে পাওয়ার গ্রিডের বৈদ্যুতিক লাইন, গ্যাস লাইন, পানির লাইন ইত্যাদি সংযোগ রয়েছে। এসবের ক্ষতি করে আমরা এমন লাইন কোনোভাবেই চাই না।
এলাকাবাসীর পাশাপাশি পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশও চায় না স্যুয়ারেজ লাইন, ডাস্ট ওয়াটার লাইনের কাজ এখানে হোক। সেজন্য পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের ঢাকা এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্রিড সঞ্চালন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (প্রধান প্রকৌশলী) মো. আবুল কাশেম ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল ১০ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমানকে চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রকল্পের মাধ্যমে ডেসকোর আওতাধীন বসুন্ধরা, আফতাবনগর, স্বদেশ প্রপার্টিস সহ বেরাইদ এলাকার বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রামপুরা-বসুন্ধরা ১৩২কেভি আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল লাইন (প্যাকেজ-২) নির্মাণ করা হচ্ছে। যা আফতাবনগর, ইস্টার্ন হাউজিং, স্বদেশ প্রপার্টিস, বেরাইদ রোড, ইউনাইটেড সিটি এবং বসুন্ধরা সিটি এলাকা দিয়ে অতিক্রম করছে। এ লাইনের আফতাবনগর অংশে ইতোমধ্যে ডাক্ট পাইপ লে করা হয়েছে এবং বর্তমানে ক্যাবল লাইনিংয়ের কাজ চলমান। ক্যাবল লাইনটি আফতাবনগর প্রধান সড়কের পার্শ্ব বরাবর সংযুক্ত রুট অনুযায়ী স্থাপন করা হচ্ছে।
আনন্দ গর থেকে রামপুরা খাল পর্যন্ত একটি আরসিসি পাইপ নর্দমা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত রুট দিয়ে নির্মাণাধীন ‘রামপুরা-বসুন্ধরা ১৩২কেভি আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল লাইন’ ছাড়াও পাওয়ার গ্রিডের গুরুত্বপূর্ণ হাইভোল্টেজ ক্যাবল লাইন স্থাপিত রয়েছে।
এ অবস্থায় প্রস্তাবিত আরসিসি পাইপ দিয়ে নর্দমা স্থাপনে জাতীয় গ্রিডের গুরুত্বপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইনগুলোর নিরাপত্তার স্বার্থে ‘রামপুরা-বসুন্ধরা ১৩২কেভি আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল লাইন’ এবং বিদ্যমান হাইভোল্টেজ ক্যাবল লাইন রুট পরিহার করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-১০ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমানকে চিঠি দিয়েছেন জহুরুল ইসলাম সিটি সোসাইটির সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন ঢালী এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম কামাল।
চিঠিতে তারা আনন্দনগর এলাকার স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগ আফতাবনগর বনশ্রী খালে না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
এতে বলা হয়, ৩৭নং ওয়ার্ডের আনন্দনগর এলাকার স্যুয়ারেজ ও অন্যান্য ময়লা পানি অপসারণে আফতাবনগরের রাস্তা কেটে আফতাবনগর ও বনশ্রীর মাঝের খালে ফেলার জন্য স্যুয়ারেজ/ডাস্ট ওয়াটার লাইন করতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ছয় ফিট চওড়া লাইন টানার জন্য সদ্য নির্মিত আফতাবনগরের একশ ফিট পিচঢালা প্রধান সড়কের উত্তর অংশ ও এভিনিউ পাঁচ এর ৩০ ফিট সড়কটির ১৫ ফিট গভীর ও ১০ ফিট চওড়া গর্ত করা হবে। এ লাইন টানা ও রাস্তা মেরামতে দীর্ঘসময় লাগবে। এতে এলাকাবাসী যাতায়াতে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, তাছাড়া যে সড়ক দিয়ে লাইন টানার প্রস্তাব করা হয়েছে সে সড়কের নিচ দিয়ে পাওয়ার গ্রিডের ২৩০ কেভির ১৮টি বৈদ্যুতিক লাইন, গ্যাস লাইন, পানির লাইন ইত্যাদি সংযোগ রয়েছে। আফতাবনগর-বনশ্রী লেকে বাসা-বাড়ির ময়লা পানি ফেলার বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যার কারণে বিশাল আফতাবনগর প্রকল্প এলাকায় স্যুয়ারেজ/ডাস্ট ওয়াটার লাইন এখন পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। সেজন্য আফতাবনগর এলাকাবাসী খুবই অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় আনন্দনগর স্যুয়ারেজ, ময়লা পানি নিষ্কাশনের লাইন আনন্দনগরের ভেতর দিয়ে সরাসরি খালে অথবা বাড্ডা প্রধান সড়কের স্যুয়ারেজ লাইনে সংযোগ প্রদান করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। অন্যথায় আমরা আদালতের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হব।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-১০ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কাজটির বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
অন্যদিকে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের পক্ষ থেকে পরিচালক মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-১০ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমানকে চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের পক্ষ থেকে বলা হয়, জহুরুল ইসলাম সিটি (আফতাবনগর) প্রকল্পটি একটি সুপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। ১৯৮৭ সালে রাজউক থেকে অনুমোদিত এ প্রকল্পে বর্তমানে হাজার হাজার নাগরিক বসবাস করছে। বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা-২০০৪ (সংশোধিত- ২০১২ ও ২০১৫) এর শর্তানুযায়ী এ প্রকল্পের নাগরিক সুবিধা বাস্তবায়নের ফলে এটি একটি পরিবেশবান্ধব বসতি হিসেবে গড়ে উঠেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা হিসেবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও স্টর্ম ওয়াটার লাইন ছাড়াও আন্ডারগ্রাউন্ড হাইভোল্টেজ ইলেকট্রিক লাইন, অপটিক্যাল ফাইবার লাইন ও অন্যান্য ইউটিলিটি লাইন বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ও ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে যৌথভাবে সাইট পরিদর্শনে দেখা যায়, প্রস্তাবিত আরসিসি নর্দমা পাইপ নেটওয়ার্কের আউটলেটটি আফতাবনগর প্রকল্পের অভ্যন্তরে অবস্থিত বারুদিয়া লেইকের মধ্যে নির্গমন হবে এবং এই আরসিসি নর্দমা পাইপ নেটওয়ার্কের অ্যালাইনমেন্টে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যেমন এমআরটি সাউথ স্টেশন পয়েন্টসহ প্রায় ১৭টি ইউটিলিটি লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার মধ্যে ২৩০ কেভি হাইভোল্টেজ জাতীয় গ্রিড লাইনও রয়েছে। ফলে এটি প্রকল্পবাসীর জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। তাছাড়া বাসাবাড়ির তরল বর্জ্য ও ময়লা পানি খালে ফেলার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই আনন্দনগরের স্যুয়ারেজ লাইনটি কোনোভাবেই আফতাবনগর খালে সংযোগ দেওয়া উচিত হবে না।
তাছাড়া প্রকল্পের বাইরের বর্জ্য ও দূষিত পানি ওই লাইনের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে প্রকল্পের খালের পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করবে। নানারকম পানিবাহিত রোগজীবাণু ছড়াবে, ডেঙ্গুর প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি প্রতিবেশ ও পরিবেশের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ফলে প্রকল্পে বসবাসকারী নাগরিকদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত আরসিসি পাইপ নর্দমা নেটওয়ার্ক স্থাপনের উদ্যোগটি এলাকার নাগরিকদের জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্লট মালিক সমিতি থেকে আপত্তি জানিয়েছেন এবং প্রয়োজনে মালিক সমিতির পক্ষ হতে আইনি পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের পক্ষ থেকে আফতাবনগর প্রকল্পের বাইরের কোনো আরসিসি নর্দমা লাইনকে প্রকল্পের অভ্যন্তরে প্রবেশ না করানোর ব্যাপারে জোরালো আপত্তি জানানো হয়েছিল। কিন্তু সভার কার্যপত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত মতামত উল্লেখ করা হয়েছে, যা সঠিক নয়।
তাছাড়া প্রকল্পের নতুনভাবে নির্মিত পিচঢালা রাস্তাগুলো কেটে ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর ও ১০ ফুট চওড়া গর্ত করে ড্রেনেজের নির্মাণ করতে গেলে যান চলাচল ও পথচারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে। দক্ষিণ আনন্দনগর এলাকাটি আফতাবনগর প্রকল্পের বাইরে অবস্থিত একটি বিচ্ছিন্ন এলাকা। বহু বছর ধরে এ এলাকার ময়লা পানিকে তাদের নিজেদের এলাকার অভ্যন্তরের ড্রেনেজ অ্যালাইনমেন্টের মাধ্যমে নিষ্কাশন করা হয় বিধায় তাদের নিজেদের লাইন ব্যবহারের মাধ্যমে আরসিসি নর্দমা নির্মাণ করে বিষয়টি সুষ্ঠু সমাধান করা যায়।
এ অবস্থায় আফতাবনগর প্রকল্পের বাইরে অবস্থিত আনন্দনগর থেকে দূষিত পানি ও তরল বর্জ্য বহন করে প্রকল্পের অভ্যন্তরে খালের মধ্যে ফেলার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত আফতাবনগরের অ্যালাইনমেন্টটি বাতিল করে আনন্দনগর এলাকার তরল বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য তাদের নিজস্ব জায়গা ব্যবহার করে স্যুয়ারেজ নেটওয়ার্ক নির্মাণের জন্য অনুরোধ করছি।