আর্চারি বা তীরন্দাজি পৃথিবীর প্রাচীনতম খেলা। প্রাচীনকালে তীর বা ধনুক ব্যবহার করে পশু শিকার করা হতো। পরবর্তীকালে হস্তনির্মিত অস্ত্র হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে এর বহুল প্রচলন ঘটে। এটি গোলন্দাজ সৈন্যবিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।
নিখুঁত লক্ষ্যভেদে এর জুড়ি ছিল না এবং দক্ষ তীরন্দাজরা যুদ্ধ জয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতেন। আদি ইতিহাস থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তীর-ধনুক একটি অত্যাবশ্যক অস্ত্র ছাড়াও একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলা আর্চারি হিসেবে দেশ ও জাতীয় সীমা পেরিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে সারা বিশ্বে। বাংলাদেশে এই খেলার খুব বেশি প্রচলন না দেখা গেলেও বর্তমানে দেশে এই খেলার বিভিন্ন ক্লাব আছে। গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন।
এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকার তথ্য মতে, তীর-ধনুকের উৎপত্তি বহু বছর আগে। আজ থেকে প্রায় ৬১ হাজার বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার সিবুদু গুহায় হাড়ের তীর পাওয়া গেছে।
আরব সমাজেও হাজার হাজার বছর আগে তীরন্দাজি বেশ জনপ্রিয় ছিল। ‘আবুল আরব’ (আরব জাতির পিতা), ইবরাহিম (আ.)-এর জ্যৈষ্ঠ পুত্র ও নবীজি (সা.)-এর পূর্ব পুরুষ ইসমাইল (আ.)-ও তীরন্দাজিতে বেশ পারদর্শী ছিলেন।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) একদল লোকের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যারা তীরন্দাজি করছিল। তিনি বলেন, ‘হে ইসমাঈলের বংশধর, তোমরা তীরন্দাজি করো। কেননা তোমাদের পিতা ছিলেন তীরন্দাজ। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮১৫)
আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.)-ও তীরন্দাজি পছন্দ করতেন। সাহাবায়ে কেরাম যখন তীরন্দাজে লিপ্ত হতেন, তখন তিনি মনোযোগসহ দেখতেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, আবু তালহা (রা.) নবী (সা.)-এর সঙ্গে একই ঢাল ব্যবহার করেছেন। আর আবু তালহা (রা.) ছিলেন একজন ভালো তীরন্দাজ। তিনি যখন তীর ছুড়তেন, তখন নবী (সা.) মাথা উঁচু করে তীর যে স্থানে পড়ত তা নজর রাখতেন। -(বুখারি, হাদিস : ২৯০২)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, সালামা ইবনে আকওয়া (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) আসলাম গোত্রের একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা তীরন্দাজি চর্চা করছিল। মহানবী (সা.) বলেন, হে বনু ইসমাঈল, তোমরা তীর নিক্ষেপ করতে থাকো। কেননা তোমাদের পূর্বপুরুষ দক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন এবং আমি অমুক গোত্রের সঙ্গে আছি।
বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শুনে দুই দলের একদল তীর নিক্ষেপ বন্ধ করে দিল। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের কী হলো যে তোমরা তীর নিক্ষেপ করছ না? তারা জবাব দিল, আমরা কিভাবে তীর নিক্ষেপ করতে পারি, অথচ আপনি তাদের সঙ্গে আছেন? মহানবী (সা.) বলেন, তোমরা তীর নিক্ষেপ করতে থাকো, আমি তোমাদের সবার সঙ্গে আছি। ’ (বুখারি, হাদিস : ২৮৯৯)
এমনকি কোনো কোনো হাদিসে এমনও পাওয়া যায় যে নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে যে কয়টি খেলার অনুমোদন দিয়েছিলেন তার মধ্যে তীরন্দাজি অন্যতম ছিল। এবং তিনি এ খেলায় আরো বেশি দক্ষতা অর্জনের জন্য অনুশীলন অব্যাহত রাখার প্রতি তাগিদ দিতেন।
উকবাহ ইবনে আমির (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, একটি তীরের কারণে মহান আল্লাহ তিন ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তীর প্রস্তুতকারী, যদি সে (মুসলিম জাতি রক্ষার) লড়াইয়ের নেক আশায় প্রস্তুত করে, (যুদ্ধে) তীর নিক্ষেপকারী এবং যে ব্যক্তি তা নিক্ষেপের উপযোগী করে নিক্ষেপকারকে সরবরাহ করে। তোমরা তীরন্দাজি ও অশ্বারোহী প্রশিক্ষণ নাও। তোমাদের অশ্বারোহীর প্রশিক্ষণের চেয়ে তীরন্দাজির প্রশিক্ষণ আমার কাছে বেশি প্রিয়।
তিন ধরনের খেলাধুলা অনুমোদিত—কোনো ব্যক্তির তার ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, নিজ স্ত্রীর সঙ্গে খেলা-স্ফূর্তি করা এবং তীর-ধনুকের প্রশিক্ষণ নেওয়া। যে ব্যক্তি তীরন্দাজি শিখার পর অনাগ্রহবশত তা ছেড়ে দেয়, সে আল্লাহর দেওয়া এক নিয়ামত বর্জন করল। অথবা তিনি বলেছেন, সে এই নিয়ামতের অকৃতজ্ঞ হলো। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৫১৩)
লেখক: সাংবাদিক, আলেম লেখক,গবেষক, খতিব ও মাদরাসা-শিক্ষক