ঢাকা বৃহস্পতিবার, মে ২, ২০২৪

Popular bangla online news portal

Janata Bank
Rupalibank

মায়ের কাছে পাখিপ্রেমের হাতেখড়ি


নিউজ ডেস্ক
১৭:৪৮ - রবিবার, মার্চ ১৭, ২০২৪
মায়ের কাছে পাখিপ্রেমের হাতেখড়ি

শাহরিয়ার হোসেন শাহ পরান

২০০৬ সালের কোনো এক চৈত্রের খাঁ খাঁ দুপুর । প্রাইমারী স্কুলের হাফবিল্ডিংটা ভেঙ্গে সেখানে নিমার্ণ করা হবে দু'তলা একটি বিল্ডিং ঘর । স্কুলের ছেলেমেয়েরা ক্লাস করছে পাশের আরেকটি পাকা বিল্ডিংয়ে । ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছেন আতোয়ার স্যার । ইংরেজির শিক্ষক , এজন্য ওনি একটু বেশিই কড়া । কেউ কথা বললে কান মলে চুপ করাচ্ছে । তবুও ক্লাসে ছেলেমেয়েগুলো চুপিচুপি কথা বলছে হাফবিল্ডিংটা ভাঙ্গা নিয়ে । সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে ,কখন স্যারের ক্লাস শেষ হবে। তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ স্যারের ক্লাস শেষ হলো । সবাই হুড়োহুড়ি করে বেড়িয়েই , ছুটছে সেই হাফবিল্ডিং ভাঙ্গার দৃশ্য দেখার জন্য । টিনের চালগুলো যখন খোলা হলো , ১০/১৫টির মতো পেঁচা টিনের চালের নিচ থেকে বেড়িয়ে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে লাগলো । সম্ভবত পেঁচাগুলো প্রস্তুত ছিলো না এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মূহুর্তে  পড়ার জন্য । এদের মধ্যে আবার কিছু কিছু ছোট্ট পেঁচাও ছিলো । ছোট্ট পেঁচাগুলো বেশি একটা উড়তে পারেনা , সেইজন্য স্কুলের ছেলেমেয়েরা পেঁচাগুলোকে ঢিল দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো । কারণ গ্রামে বিশ্বাস করা হতো পেঁচা অশুভ । একে তাড়ানো ভারি ভালো কাজ । তাড়া খেয়ে পেঁচাগুলো হাফবিল্ডিংটার পাশের মস্ত মস্ত আমগাছগুলোয় আশ্রয় নিয়েছিলো । তারপরও তাদের ঢিল থামেনি ,কারণ অশুভ পাখিগুলোকে তাড়ায় দিতেই হবে । সেই তাড়া খেয়ে স্কুলঘরের পেঁচাগুলো যে কোথায় হারিয় গেলো ,এরপর আমার গ্রামে আমি নিজে কখনোও আর পেঁচা দেখিনি । স্কুলঘরের পেঁচাগুলোর দিকে ঢিল ছোঁড়াদের দলে আমিও একজন ছিলাম । হয়তো সেই  অহেতুক ঢিলছোঁড়ার অপরাধে , আমার নিজের গ্রামে তাদের কখনো দেখিনি । অভিমান করেই হয়তো ওরা চলে গিয়েছিলো আমাদের গ্রাম ছেঁড়ে অন্যগ্রামে ।

গ্রামে থাকার সুবাদে যারা পাখি ধরতো তাদের সাথে মাঝেমধ্যেই পাখি ধরা দেখতে যেতাম । টুনটুনি ,চড়ুই ,শালিক, টিয়া ,ঘুঘু ইত্যাদি পাখি প্রায়ই ধরতো আমার গ্রামের অনেকেই । কিন্তু আমি নিজে কখনো নিজ হাতে পাখি ধরিনি । তবে একদিন আমাদের বাড়ির পেছনের আড়া(জংলা) থেকে খুসকা গাছের পাতায় মোড়ানো বাসা থেকে টুনটুনির বাচ্চা ধরে নিয়ে আসি । ঐদিকটায় বাচ্চা টুনটুনির মা ,এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করছে । আর এদিকে আমি বাচ্চা টুনটুনিকে নিয়ে পুরো পাড়া দেখিয়ে বেড়াচ্ছি । এরপর,বাচ্চা টুনটুনিকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসি । বাড়িতে ঢুকার পর আমার মা , আমার হাতে পাখি দেখে হতবাক । মা প্রথমে আমাকে অনেক বুঝালেন,কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা । কোনভাবেই ছাঁড়বে না । এরপর যখন মন খারাপ করে বললেন-"বাবা , এসব পাখি ধরতে নেই , এদের মা বদদোয়া দিবে","তোকে যদি আমার কাছ থেকে কেউ নিয়ে যায়,তখন আমার কেমন লাগবে"।এরপর মা-টুনটুনিটির উড়াউড়িও দেখালেন বাচ্চা টুনটুনির জন্য। অবশেষে আম্মার কথায় টুনটুনির বাচ্চাটা ছেঁড়ে দিয়েছিলাম । আম্মা খুবই পাখিপ্রেমী , কখনোই কোনো পাখি ধরতে দিতো না।

আমার বেড়ে ওঠা জামালপুরের কোন  এক অজপাড়াগাঁয়ের মৃতপ্রায়  জিঞ্জিরাম নদীর তীরে।আমাদের এলাকার আশপাশটায় শীতকালে মোটামুটি বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি আসে । খাল-বিলে এসব পাখির দেখা মিলতো হরহামেশায় ।

আমাদের গ্রামটি ভারত সীমান্ত লাগোয়া হওয়ায় ভারত থেকে প্রচুর পাখি আসতো । এজন্য পাখি শিকারীর সংখ্যাটাও ছিলো অনেক বেশি । আমার বন্ধুদের অনেকেই পাখি শিকার করতে যেতো । আমারও খুব আফসোস হতো । আমিও যদি যেতে পারতাম , বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করতে । শেষে একবার সেই সুযোগ এলো । আমার এক দুলাভাই ,তার সাথে নিতে চাইলেন একদিন । শীতের টুপটাপ শিশির পড়া ভোরে উঠে ছুটলাম তার সাথে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করতে । আমাদের বাজারের বড্ড পাকুড় গাছে সারি সারি বসে আছে মিষ্টি সবুজ রঙের  হরিয়াল(স্থানীয়ভাবে আমাদের ওখানে এটাকে হরতেল পাখি বলে)। জিজু মশাই ,এদেরকে তাক করে বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়লেন ,ছফাৎ শব্দে একটি হরিয়াল নিচে পড়ে গেলো । দৌড়ে গিয়ে সেটাকে ধরলাম ,এরপর পাখিটাকে জবাই করা হলো । এরপর হাঁটা ধরলাম সিংগিডোবা বিলের দিকে , সেখানে সকালবেলা বকে-বকে বিলের জল সাদা হয়ে গেছে । এরপর একটাকে তাক করে গুলি মারা হলো ,সেটা গিয়ে পড়লো একটা বাড়ির পাশে । ঐ বাড়ির লোকজন প্রচুর বিরক্ত আমাদের ওপর বক মারার জন্য । কিছুক্ষণ রাগও ছুঁড়ে গেলো । এরপর , বাড়িতে ফেরার পালা । বাড়ি ফেরার সময় শুধু ঐ বাড়ির লোকজনগুলোর কথা বারবার মনে হচ্ছিল । ওরা চাইলে বিলের বক যখন-তখন শিকার করতে পারে । কিন্তু তারা তা না করে বিলে ওইভাবে কাউকে বক কিংবা অন্যকোনো পাখিই মারতে দিত না । কারণ ওসব পাখিরা ওদের খুব কাছের হয়ে গিয়েছিলো । সেদিনটাও খুব কষ্ট হচ্ছিল । আর মনের গভীর থেকে অল্প অল্প করে পাখিদের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিচ্ছিলো । পাখিদের প্রতি ভালোবাসাটা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে । পাখি শিকারের কথা মাকে বলাতে ,মাও খুব কষ্ট পেয়েছিলো । মা খুব করে বলছিল "এমন ভুলগুলো যেন কখনওই আর না করি,পাখিদেরও ঘর সংসার আছে", "ওদেরও স্বপ্ন থাকে, বাচ্চাদের জন্য কখনও খাবার নিয়ে ফেরা হয়না যখন আমরা ওদেরকে ধরি", "একসাথে কয়েকটা প্রাণ নষ্ট হয়ে যায় ,আমরা কি জীবন দিতে পারবো তাদের ?", "কখনোই পারবো না , যে জিনিস আমি তৈরি করতে পারবো না , সেটা নষ্ট করার অধিকারও আমাদের নেই"। মায়ের কথাগুলো আর ঐ বিলের পাড়ের বাড়ির লোকজনের কথাগুলো কানে খুব বাজছিলো সেদিন । এরপর থেকে পাখিপ্রেমটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে । আমার এলাকায় কেউ আর এখন বন্দুক নিয়ে ঘুরেনা । পাখি শিকারের জন্য ফাঁদও পাততে পারেনা । যতটুকু সম্ভব মানুষকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-২০১২ এর কথা বলি । আগে বন-জঙ্গলে ছুটতাম পাখি ধরতে ,এখন বনে-জঙ্গলে যাওয়া হয় পাখি দেখতে । চোখের সামনে বড় বড় গাছ পড়লে পাখি খুঁজি চোখ নামের লেন্স দিয়ে । দিন দিন বাড়তেই থাকুক পাখির প্রতি এ ভালোবাসা ।